দুই মাস মাসিক না হওয়ার কারণ কি?
আমরা সাধারণত ভাবি যে প্রেগন্যান্ট হলেই শুধু মাত্র মাসিক বন্ধ হয়। আসলে বিষয়টা কিন্তু এমন না। আপনার মাসিক অনেক কারণেই বন্ধ হতে পারে। যেমন আপনার আপনার বর্তমান লাইফস্টাইল এবং অন্যান্য মেডিক্যাল ফ্যাক্টরগুলোর জন্যও দুই মাস পিরিয়ড বন্ধ থাকতে পারে।
শরীরের ওজনের পরিবর্তন, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা এবং মেনোপজ হল এর অন্যতম কারণ। এসব কারণে আপনার পিরিয়ড দুই মাস না হতে পারে। এমনকি এমেনোরিয়া রোগের জন্যও আপনার পিরিয়ড মিস হতে পারে অর্থাৎ দুই মাস মাসিক না হতে পারে।
সাধারণত একজন মহিলার মাসিক সাইকেল হল ২১ দিন থেকে ৩৫ দিনের। যেদিন থেকে আপনার পিরিয়ড শুরু হয় সেদিনই হল আপনার পরবর্তী মাসিকের প্রথম দিন। সাধারণত আপনার মাসিকের দিন সর্বোচ্চ ৩৮ দিন হতে পারে। যদি আপনার পিরিয়ড ৩৮ দিনের থেকে বেশি দেরি করে হয় তাহলে বুঝতে হবে আপনার অনিয়মিত পিরিয়ড হচ্ছে।
এই আর্টিকেলে আমরা ২ মাস মাসিক না হওয়ার কারণ নিয়ে আলোচনা করবো।
দুই মাস মাসিক না হওয়ার কারণ কি?
দুইমাস মাসিক না হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। এর ভিতর আমরা সবচেয়ে প্রোমিনেন্ট দশটি কারণ নিয়ে আলোচনা করবো।
স্ট্রেস বা অবসাদগ্রস্থতা ২ মাস মাসিক না হওয়ার কারণ
অতিরিক্ত অবসাদগ্রস্থতা গোনাডোট্রপিন হরমোন নিঃসরণে বাধা দেয়। গোনাডোট্রপিন হরমোন মাসিক চক্র ও ডিম্বাণু পরিস্ফুটন নিয়ন্ত্রণ করে।
শারীরিক ও মানসিক অবসাদগ্রস্থতা মাসিক ২ মাস দেরিতে হওয়ার কারণ হতে পারে। যদি এমন হয় যে,আপনার অবসাদগ্রস্থতার জন্য পর পর তিন মাস মাসিক মিস হয়েছে তাহলে অবশ্যই আপনার ডাক্তার দেখান উচিত।
ডাক্তার আপনাকে কাউন্সেলিং করবে এবং আপনার স্ট্রেস দুর করার চেষ্টা করবে। যখন আপনার স্ট্রেস সহনীয় পর্যায়ে আসবে তখনই কিছু মাস পর আপনার মাসিক সাইকেল রেগুলার হতে পারে।
অতিরিক্ত ব্যায়াম ২ মাস মাসিক না হওয়ার কারণ
অতিরিক্ত ব্যায়ামের ফলে মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি ও গলার থাইরয়েড গ্রন্থি কিছুটা অন্যরকম হতে পারে যার জন্য ২ মাস মাসিক নাও হতে পারে। কারণ পিটুইটারি গ্রন্থি ও থাইরয়েড গ্রন্থি মাসিক নিয়ন্ত্রণ ও ডিম্বাণু পরিপক্ক হতে সাহায্য করে। দিনে এক বা দুই ঘন্টা ব্যায়াম করলে তেমন কিছু হয় না তবে এর থেকে বেশি ব্যায়াম করলে আপনার ২ মাস মাসিক না হতে পারে।
যদি আপনি ঐরকম বেশি ব্যায়াম করার চিন্তা ভাবনা করে থাকেন তাহলে ব্যায়াম করার আগে স্পোর্টস ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিবেন। তারা আপনাকে আপনার খাদ্যাভাস পরিবর্তনসহ সবচেয়ে ভালো খাবার খেতে উপদেশ দিবেন যা কিনা আপনার শরীরের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করবে।
অসুস্থতা দুই মাস মাসিক না হওয়ার কারণঃ
আমি বেশ কিছু রোগী দেখছি যাদের কিনা মাসিক হত না। কিন্তু পরে বিভিন্ন টেস্ট করে দেখা যায় তাদের কিছু ক্রনিক রোগ থাকে যা কিনা তাদের পিরিয়ড সাইকেলকে এফেক্ট কুরে,
এসব ক্রনিক রোগের ভিতর অন্যতম হলঃ
- থাইরোয়েডে সমস্যা
- পলিসাইটিক অভারি সিন্ড্রোম
- পিটুইটারি টিউমার যা ক্যান্সার হতেও পারে নাও হতে পারে
- এড্রেনাল গ্ল্যান্ডে কোন রোগ হলে
- অভারিয়ান সিস্ট বা জরায়ুতে সিস্ট হওয়া
- লিভার যদি ঠিক মত কাজ না করে
- ডায়াবেটিস
কিছু কিছু রোগ যা কিনা জন্মের সময়ই থাকে যেমন টার্নার সিন্ড্রোম , এন্ড্রোজেন হরমোনের কম নিঃসরণ। এসব রোগের কারণে বাচ্চা জন্মদানে অক্ষমতা দেখা দেয় এবং মাসিক চক্রে বাধা পড়ে। এসব শারীরিক সমস্যা গুলো এমেনোরিয়া রোগের ভিতর পড়তে পারে।
একিউট রোগ যেমন নিউমোনিয়া, হার্ট এটাক, কিডনি ফেইলর বা মেনিনজাইটিস এর জন্য আপনার দেহের ওজন অনেক কমে যেতে পারে, অপুষ্টি দেখা দিতে পারে বা হরমোন সঠিকভাবে নাও করতে পারে। এর জন্য আপনার দুই মাস মাসিক নাও হতে পারে।
২ মাস মাসিক না হওয়ার কারণ হটাত করে রুটিন পরিবর্তন হওয়া
যদি হটাত করে আপনার দৈনন্দিন জীবনের রুটিন পালটে যায় তাহলেও আপনার দুই মাস মাসিক নাও হতে পারে। যেমন উদাহরণস্বরূপ আপনি আগে দিনে অফিসের কাজ করতেন কিন্তু হটাত করে আপনার রাতে কাজ করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে আপনার দেহঘড়ি সম্পূর্ণ উলটে যেতে পারে। আর এর জন্য আপনার মাসিক দেরি করে হতে পারে।
তবে সাধারনত এমন হয় না। হটাত করে কিছু মহিলাদের ক্ষেত্রে এমন হয়।
মেডিসিন বা ঔষুধ
কিছু কিছু ঔষুধ যেমন এন্টিডিপ্রেসান্টস, এন্টিসাইকোটিকস, থাইরয়েডের ঔষুধ, এন্টিকোনভালসান্ট এবং কিছু কেমোথেরাপির জন্য পিরিয়ড দেরিতে হতে পারে।
হরমোনাল ঔষুধগুলো যেমন ডেপো-প্রোভেরা, প্রোজেস্টেরন পিল, মিরেনা আইইউডি এবং নেক্সপ্লানোন ঔষুধগুলো মাসিক চক্রকে প্রভাবিত করতে পারে।কিছু কিছু ঔষুধ হেভি পিরিয়ড হওয়ার জন্য দায়ী থাকে , আবার কিছু ঔষুধ লাইট পিরিয়ড হওয়ার জন্য দায়ী।
জন্মনিরোধক পিল গ্রহণ করলেও পিরিয়ড দেরি করে হয় না দুই মাস পরে মাসিক হয়।
ওজন পরিবর্তন
অতিরিক্ত ওজন মাসিক চক্রে বিশাল ইম্প্যাক্ট ফেলে। মোটা হলে এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিক হয়ে পড়ে। এর জন্য মাসিক দেরি করে হয়।
যদি আপনার বডি ম্যাস ইন্ডেক্স বা বিএমআই অনেক বেশি হয় তাহলে মাসিক মিস হতেও পারে। যদি আপনি আপনার শরীরের ওজন কমিয়ে ফেলেন তাহলে আপনার মাসিক চক্র আবার আগের মত হতে পারে।
আবার আপনার শরীরের ওজন যদি খুবি কম হয় বা বিএমআই মান কম হয় তাহলে আপনার হরমোনগুলো ঠিকমত কাজ করতে পারে না। এর জন্য আপনার পিরিয়ড মিস হতে পারে।
আপনার মাসিক কেবল মাত্র শুরু হয়েছে
যদি এমন হয় যে কয়েকমাস হয়েছে আপনার মাসিক শুরু হয়েছে সেক্ষেত্রে আপনার ২ মাস মাসিক নাও হতে পারে। এমনকি আমি এমনও দেখছি যে তার ১২ বছরে মাসিক শুরু হয় ও তা ২/৩ মাস এর মত ছিলো। কিন্তু এর পর মাসিক আর ২ বছর ধরে হয় নাই। দুই বছর পর আবার তার মাসিক নিয়মিতভাবে শুরু হয়।
পেরিমেনোপজ ও মেনোপজ
পেরিমেনোপজ হল যখন আপনি সন্তান ধারণ ক্ষমতা অর্জন করবেন। সাধারণত মেয়েদের মাসিক শুরু হওয়ার কয়েক বছর পরেই সন্তান ধারণ করার ক্ষমতা অর্জন করে। তখন মাসিকের রক্ত কম হতে পারে, বেশি হতে পারে, ঘন ঘন মাসিক হতে পারে বা দেরিতে মাসিক হতে পারে। সাধারণত তখন মাসিক এর সাইকেল অন্য রকম হবে।
মেনোপজ হল যখন আপনি সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা হারাবেন তখন। গড়ে মেনোপজের বয়স হল ৫১ বছর। তবে অনেকের ক্ষেত্রে মেনোপজ ৪৫ বছর থেকে শুরু হয়।
ব্রেস্টফিডিং
বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানোর সময় হালকা মাসিক, অনিয়মিত মাসিক বা মাসিক নাও হতে পারে। কারণ তখন স্তনে দুধ উৎপাদনের হরমোন এক্টিভ থাকে। এর জন্য মাসিকে একটু অসুবিধা দেখা দেয়।
অনেকে আবার ব্রেস্টফিডিংকে বার্থকন্ট্রোলও মনে করে। এটি প্রেগন্যান্ট হওয়ার চান্স অনেক কমিয়ে দেয়। তবে এমনও হয় যে,আপনি ব্রেস্ট ফিডিং করছেন এবং আপনার মাসিক হচ্ছে না। কিন্তু আপনি তখন কনডম ছাড়া সহবাস করলে প্রেগন্যান্ট হবেন। যদি আপনি বাচ্চা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত না থাকেন তাহলে অবশ্যই কনডম ব্যবহার করা উচিত।
ওভারিয়ান ক্যান্সার বা জরায়ুতে ক্যান্সার
অনেক সময় এমন হয় যে, আপনার মাসিক বন্ধ , প্রেগন্যান্সি টেস্ট এ পজিটিভ আসছে, এবং আপনার দেহে প্রেগন্যান্টের সব লক্ষন উপস্থিত থাকে। তখন অনেকে ভাবে যে সে প্রেগন্যান্ট। এরজন্য সে সব প্রস্তুতি নিতেও থাকে। আল্ট্রাসাউন্ড তখন বাচ্চার মত কিছু দেখা যায়। এসব দেখে সে ভাবতে পারে যে সে প্যাগন্যান্ট। কিন্তু অনেক সময় দেখছি যে , এগুলো জরায়ুর ক্যান্সার বা টিউমারের লক্ষন ।
দুই মাস মাসিক না হলে করণীয় কি ?
আপনার যদি দুই মাস মাসিক না হয় তাহলে আপনার অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। কারণ মাসিক না হওয়ার কারণ অনেক কিছু হতে পারে। ডাক্তারই বলতে পারবেন আপনার মাসিক না হওয়ার কারণ।
সর্বশেষ
আসলে দুই মাস মাসিক না হওয়ার কারণ অনেক কিছুই হতে পারে। আপনার যদি একাধিকবার মাসিকের ডেট দেরি করে হয় তাহলে অবশ্যই আপনার ডাক্তার দেখানো উচিত। ডাক্তার আপনার বর্তমান ও অতীতের অবস্থা জেনে আপনাকে চিকিৎসা দিবেন। চিকিৎসার ভিতর আপনাকে লাইফ স্টাইল চেঞ্জ , হরমোন থেরাপি, খাদ্যাভাস পরিবর্তন এসব করতে বলতে পারেন।
যেহেতু আমি আপনার বর্তমান দেহের অবস্থা জানি না সেহেতু আমার পক্ষে এসব নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না। যদি আপনি চান তাহলে আপনি কমেন্ট করে জানাতে পারেন বা আমাদের ফেসবুক পেইজে মেসেজ দিতে পারেন।
মাসিকের রক্ত কম যায় কেনো? মাসিকের রক্ত কম হলে করনীয়?
Comments
Post a Comment